হোমাই ও ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল
★ হোমাই ও ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল,
★ হোমাই কি?
হোমাই হচ্ছে একটা লম্বা লাইনের সংক্ষিপ্ত বা এ্যাবরিবিয়েশন ফর্ম,
লম্বা লাইনটি হচ্ছে ইংরাজিতে --
Homoeopathic Medical Association of India,
★ গোল্ডেন জুবিলী বলা হচ্ছে কেন, ব্যাপারটি কি?
কারণ, হোমাই তৈরি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, এবারে অর্থাৎ ২০২৫ সালে তার ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে, তাই গোল্ডেন জুবিলী উৎসব বলা হচ্ছে!
--- ভারতে হোমিওপ্যাথির চর্চা ২০০ বছর ধরে হলেও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের সংগঠন গড়ে উঠেছে অনেক পরে।
১) ১৯৩২ সালে কলকাতার ডাঃ জিতেন্দ্র নাথ মজুমদারের বিশেষ প্রচেষ্টায় এবং উত্তর প্রদেশের ডাঃ কৈলাসনাথ কাটজুর সহযোগিতায় ভারতের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের প্রথম সংগঠন গড়ে ওঠে অল ইন্ডিয়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল এসোসিয়েশন নাম দিয়ে। এই এ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি ছিলেন তখন কলকাতায় যাকে বাংলার হ্যানিম্যান বলা হতো সেই ডাঃ ইউনান সাহেব, এবং সাধারণ সম্পাদক হন ডাক্তার জিতেন্দ্রনাথ মজুমদার।
২) ১৯৪৪ সালে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের আরেকটি সর্বভারতীয় সংগঠন করে ওঠে, নাম দেওয়া হয় --অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হোমিওপ্যাথি। এটির সদর অফিস হয় দিল্লিতে। প্রথম সম্পাদক হন দিল্লির ডাঃ কে জি সাক্সেনা।
৩) ১৯৭৫ সালে সব সংগঠনগুলিকে এক করে সবাইকে এ্যলোপ্যাথিক চিকিৎসকদের I M A বা ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মতন দেশের সব হোমিওপ্যাথদের একসাথে থাকার জন্য এবং এক ছাতার নিচে আনার জন্য নিজের প্র্যাকটিস, খাওয়া দাওয়া ঘুম, বিশ্রাম, সব ছেড়ে পাগলের মতন ছুটতে লাগলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, যিনি আর কেউ নয় -- পূর্ববাংলা থেকে আসা একজন রিফিউজি হোমিওপ্যাথ, যিনি এতদিনে একজন স্বনামধন্য হোমিওপ্যাথি হিসাবে নাম করে ফেলেছেন সেই ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল।
ডাঃ কাঞ্জিলাল তৈরি করলেন হোমাই, অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া।
সংগঠন করার জন্যই বোধহয় মানুষটি জন্মেছিলেন।
১৯৩৬ সালে আর জি কর মেডিকেল কলেজ থেকে এম বি পাশ করে দুই বছর গাইনি ডিপার্টমেন্টে হাউসস্টাফ করার পরে ১৯৩৮ সাল থেকে তার নিজ গ্রাম খুলনার দৌলতপুরে প্র্যাকটিস শুরু করলেও অচিরেই চিকিৎসা করার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িয়ে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত থাকার জন্য মাঝেমধ্যে ছোটখাটো জেল যাত্রা হলেও ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর কারাবাস ভোগ করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারে।
একবার জেলে তিনি অনশন আরম্ভ করেছিলেন এবং ৬১ দিন অনশনও করেছিলেন। জেলে তিনি কয়েদিদের নিয়ে সংগঠন তৈরি করেছিলেন।
১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন তাঁকে আবার অন্য একটি মামলায় শীঘ্রই ধরা হবে। ততদিনে তার সংসার ভেঙে তচনচ হয়েছে। স্ত্রী ও সন্তানরা অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে আছে।
সবার অনুরোধে তিনি স্ত্রী পুত্র কন্যাদের নিয়ে ১৯৫৫ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর রাত ১২ টায় পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। সম্বল বলতে ছিল বন্ধুদের তুলে দেওয়া ১৫০টি পাকিস্তানি টাকা।
কলকাতায় তার প্রথম দিকের কষ্টের জীবন এখানে আর বলছি না। তা আগে একটা বড় প্রতিবেদনে ডিটেলস লিখেছি।
যাই হোক, হোমাই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতীয় হোমিওপ্যাথদের মধ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রাণবন্ত যোগাযোগ। তার এই ভূমিকা ভারতীয় হোমিওপ্যাথদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমরা যেখানে ব্যক্তিগত কাজের জন্যও একদিন চেম্বার বন্ধ করতে চাই না, সেখানে হোমাইয়ের কাজের জন্য তিনি রবিবার ও সোমবার দুইদিন চেম্বার বন্ধ রাখতেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল ভালো হোমিওপ্যাথ তৈরি করা, তামাম ভারতবর্ষের হোমিওপ্যাথদের মধ্যে ভ্রাতৃবন্ধন তৈরি করা।
তিনি বলতেন, একজন কৃষক যত ধানের বীজ ছড়ায় তার সবগুলিতে গাছ হয় না৷ আমিও বীজ ছড়িয়ে যাচ্ছি, যেগুলি বাঁচবে সেগুলি বিকশিত হয়ে হোমিওপ্যাথিকে বিকশিত করবে।
হোমাই সংগঠনকে শক্তিশালী করা এবং ঠিক মতন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার একমাত্র নেশা ও পেশা। অনেক সময় চেম্বারে রোগীদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখে হোমাই সংগঠনের কাজ করেছেন। চেম্বারে আগত হোমাই সংগঠনের কর্মী বা নেতাদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছেন। অনেক সময় অনেক রোগী অধৈর্য হয়ে পড়লে তিনি পরিষ্কার ভাবে বলে দিতেন --দেখো বাপু, আমি ভালো হোমিওপ্যাথ তৈরির কাজে ব্যস্ত, কারণ এরাই আমার অবর্তমানে তোমাদের সেবার কাজে লাগবে৷ তাই যদি কারুর অপেক্ষা করার ধৈর্য না থাকে আমাকে ছেড়ে চলে যাও, অন্য কাউকে দেখিয়ে নাও।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামশেদপুরে ডাঃ কাঞ্জিলালের হাতে তৈরী হোমাইয়ের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় হোমাইয়ের দ্বিতীয় কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে তাঁকে আজীবন হোমাইয়ের সম্মানীয় সভাপতি হিসাবে বরণ করা হয়েছিল যা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনা।
ডাঃ জে এন কাঞ্জিলালের পরিপূর্ণ জীবনী ও কর্ম জীবন আমি আগে একবার ফেসবুকে বড় লেখার মাধ্যমে দিয়েছি। আজকের লেখাটা তাই তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী বলার উদ্দেশ্য নয়।
তাহলে আমরা জানলাম ডাঃ কাঞ্জিলালের হোমাই গড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সারা ভারতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের একটি বড় শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা এবং দেশের সমস্ত হোমিওপ্যাথদের এক পতাকা তলে আনা।
কিন্তু ডাঃ কাঞ্জিলারের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিস্যাৎ হতে আরম্ভ করে । আমরা দেখেছিলাম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামশেদপুরে অনুষ্ঠিত হোমাইয়ের প্রথম সম্মেলনে কিসসা কুর্সিকার লড়াই। হেনস্তা হতে হয়েছিল কলকাতার বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ডাঃ নরেন্দ্র প্রসাদ রায়কে।
১৯৭৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হোমাইয়ের দ্বিতীয় সর্বভারতীয় সম্মেলনে অনেক আশা ও প্রত্যয় নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসকরা আসলেও এই সম্মেলন হয়ে উঠেছিল ক্ষমতালোভীদের ক্রীড়াঙ্গন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিসর্জিত হয়েছিল। প্রাধান্য পেয়েছিল স্বৈরশক্তির উদ্দামতা।
এরপরে প্রত্যেকটি সর্বভারতীয় সম্মেলনে দেখা গেছে চেয়ার অর্থাৎ পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি ও মারামারি, হোমিওপ্যাথিক বিজ্ঞান সভার থেকে পরের বছরে কারা কোন পদে থাকবেন সেই মিটিং, এই আলোচনা, সেই রাজনীতি, সেই কনফারেন্স হয়ে ওঠে আসল কনফারেন্স।
পদ আর চেয়ার নিয়ে বারবার বিভক্ত হয়েছে হোমাই। বিভক্ত হয়েছে বহু দলে আর উপদলে। আদর্শগত কোন সংঘাত দেখিনি, বারবার দেখেছি শুধু ব্যক্তিগত সংঘাত, স্বার্থের সংঘাত, ক্ষমতা দখলের সংঘাত, কুর্সি দখলের সংঘাত। ফলে হোমিওপ্যাথির যে বিকাশ ও উন্নতির জন্য প্রাণপাত করে ডাঃ কাঞ্জিলাল এই অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছিলেন তা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে বারবার।
বর্তমানে কোন কার্যকরী ভূমিকা দেখা যায় না এই সংগঠনের। অপহোমিওপ্যাথিতে দেশ ছেয়ে গেছে, কলেজের শিক্ষকরা অপহোমিওপ্যাথি করছে। হোমিওপ্যাথির নামে নানা রকম বুজরুকি অপহোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থা বাজার গরম করছে। হোমিওপ্যাথি শেখানোর বা পড়ানোর নামে কোন স্কুলের বা ক্লাবের ২ টি ঘর ভাড়া করে রমরমিয়ে চলছে অপহোমিওপ্যাথদের অসাধু ব্যবসা। এত বড় একটা শক্তিশালী সংগঠন এই সব অন্যায়ের কোন প্রতিকার করে না, প্রতিবাদ করে না। হ্যানিমানের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নীতি বাদ দিয়ে দিকে দিকে চলছে ৫ টি, ১০ টি ঔষধ দিয়ে রোগ লক্ষণ প্রশমিত করার এক অসাধু প্রচেষ্টা, যাকে আমি মসলা মুড়ি মার্কা চিকিৎসা বলে থাকি।
একটা বড় সংগঠনই তো পারে এরকম বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের মোকাবিলা করতে। কিন্তু এরা তা পেরেছে কি! এরা তা করেছে কি! শুধু নিজেদের পদ ও মর্যাদা বজায় রাখা ছাড়া এরা আর কিছুই করেনি!
এদের এইসব দুর্বলতার সুযোগে কমিউনিস্ট পার্টি মনোভাবাপন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা ১৯৭৮ সালে হোমাই চিকিৎসকদের মধ্যে ফাটল ধরায়। তারা রাতারাতি গজিয়ে তোলে নতুন এক হোমিওপ্যাথিক সংগঠন --
" প্রগতিশীল হোমিও চিকিৎসক ফোরাম "। কারণ, এরা ভাবে পৃথিবীর সব কিছুই অপ্রগ্রগতি, আর তারাই শুধু প্রগতিশীল। এইভাবে ডাঃ কাঞ্জিলালের হাতে তৈরি হোমাইকে ভেঙে সব জায়গায় পার্টিতন্ত্র করা তাদের মোটেই উচিত হয়নি। যদিও বামফ্রন্টের পতনের সাথে সাথে তারাও স্তিমিত হয়ে পড়েছে, অল্প সংখ্যক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এখনও টিম টিম করে জ্বালিয়ে রেখেছে এই সংগঠনটি।
যেসব অপহোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদেরকে আজকের হোমাইয়ের কর্ণধাররা প্রশ্রয় দিচ্ছে, শুধুমাত্র অর্থের লোভে বিভিন্ন অপহোমিওপ্যাথ ঔষধ কোম্পানিগুলোকে তাদের সেমিনারে আসার সুযোগ দিচ্ছে, হোমিওপ্যাথির নামে চলতে থাকা সমস্ত অপহোমিওপ্যাথি মার্কা অন্যায়কে মদত দিচ্ছে, তাদেরকে হোমাইয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় ডাঃ জে এন কাঞ্জিলালের ব্যক্তিত্বের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে আজকের প্রতিবেদন শেষ করছি ।
একটি ইন্টারন্যাশনাল হোমিওপ্যাথিক কনফারেন্সে ৫/১০ টি ঔষধ মিশিয়ে চিকিৎসা করতেন যে ব্যক্তি সেই ডাঃ প্রশান্ত ব্যানার্জি গলব্লাডার স্টোন গলিয়ে দিয়েছি বলে একটি এক্সরে প্লেট দেখানোর চেষ্টা করলে ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল সাথে সাথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন --- একদম বাজে কথা ! এই ব্যক্তি জানেই না কি করে এক্সরে প্লেট দেখতে হয়!
গল্পটি ৫/১০ টি ঔষধ একসাথে মিশিয়ে পলিফার্মেসি ওরফে মশলামুড়ি চিকিৎসা করা ডাঃ প্রশান্ত ব্যানার্জি নিজেই বলেছেন তার " The Diaries of a Stubborn Homeopath " বইয়ের ১৩৬ পাতায়।
NB: Collected from DrRobin Barman facebook Page
0 Comments